জমি ক্রয়ের নিয়মাবলী

জমি ক্রয়ের নিয়মাবলী সম্পর্কে জানার আগে আপনাকে দলিল, খতিয়ান, সি এস খতিয়ান, আর এস খতিয়ান , বি এস খতিয়ান, খানাপুরি, নামজারি, পর্চা, তফসিল, চিটা, খাজনা, দাখিলা, ডিসিআর, পয়স্তি, সিকস্তি, ফারায়েজ, ওয়ারিশ, দখলনামা, বায়নামাসহ আরো যে সকল বিষয়গুলো জানা দরকার তা নিচে নিম্নে দেওয়া হলোঃ-

দলিল:

লিখিত বিবরণ যা আইনত সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে আদালতে গ্রহণযোগ্য তাকে দলিল বলা হয়।
গ্রাম বা মৌজা ভিত্তিতে জমির মালিকদের যাবতীয় ভূসম্পত্তির বিবরণ, তথ্য ও উপাত্ত জরিপ করে জমির যেই রেকর্ড তৈরি করা হয় তাকে ‘খতিয়ান’বলা হয় । খতিয়ানে কালেক্টারের নাম, দখলদারের নাম, জমির দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ, জমির ধরণ ও ট্যাক্সের হার ইত্যাদি তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। আমাদের দেশে অনেক রকম খতিয়ান রয়েছে। এর মধ্যে প্রচলিত খতিয়ানগুলো হলো, সিএস খতিয়ান, এস এ খতিয়ান ও আরএস খতিয়ান।

সি এস খতিয়ানঃ-

জমি পরিমাপের জন্য ১৯১০সাল থেকে ১৯২০ সালের ভেতর সরকারী কর্মকর্তা বা আমিনরা দেশের প্রতিটি জমি/ভূখন্ড পরিমাপ করেন। সেই জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে ভুখন্ডগুলোর আয়তন, ভৌগলিক অবস্থান ও ব্যবহারের ধরণ ইত্যাদি জানার জন্য তারা মৌজার নকশা, প্রত্যেকটি জমির মালিক বা দখলদারের বিবরণসহ ঐ আমলে যে খতিয়ান তৈরি করেন তাহাকেই সিএস খতিয়ান হিসেবে অভিহিত করা হয়।

এস এ খতিয়ানঃ-

জমি পরিমাপের জন্য ১৯৫০ সালে জমিদারি মাইগ্রেশন ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার পর সরকার জমিদারি অধিগ্রহণ করে নেন এবং সরকারি জরিপ কর্মচারীরা মাঠে না গিয়ে সরোজমিনে সি এস খতিয়ানটি সংশোধন করেন । মূলত নতুন এই খতিয়ানটিকে এস এ খতিয়ান নামে অভিহিত করা হয়।এই খতিয়ানটিকে সর্বপ্রথম বাংলা ১৩৬২ সনে প্রস্তুত করা হয়। তখন থেকে এই খতিয়ানটি ৬২’র খতিয়ান নামেও পরিচিত।

আর এস খতিয়ানঃ-

আগের জমি পরিমাপের জরিপে উল্লেখিত ভুল ত্রুটি সংশোধনের জন্য আবার একটি জরিপ করা হয়, যেটি আর এস খতিয়ান নামে পরিচিত। আমরা উপরেই জেনেছি এস এ জরিপের ভিত্তিতে খতিয়ান তৈরি করার সময় সরকারী কর্মচারীরা জমিগুলো পরিদর্শন করেনি এবং সরোজমিনে তদন্তের অনেক ভুল রয়েছে।

সেজন্য পুনরায় জরিপের মাধ্যমে নতুন খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়। সারা দেশে এই জরিপ এখনও সমাপ্ত করা হয় নি, কিন্তু অনেক জেলায় নিজস্ব আর এস খতিয়ান চূড়ান্ত ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা নিজেরাই মাঠে গিয়ে জমিগুলো পরিমাপ করে এই খতিয়ান প্রস্তুত করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় খতিয়ানটি বি এস খতিয়ান নামেও পরিচিত।

জমি পরিমাপের জরিপে উল্লেখিত সর্ব শেষ জরিপটি ১৯৯০ সালে পরিচালনা করা হয়। রাজধানী ঢাকায় এই জরিপটি ঢাকা মহানগর জরিপ নামেও পরিচিত।

আর ও কিছু জমি ক্রয়ের নিয়মাবলী:

খানাপুরিঃ-

খানাপুরি মূলত খতিয়ান প্রস্তুত করার সময় ভূমি জরিপ ও তদন্ত করার পর মৌজার নকশা প্রস্তুতি এর জন্য খতিয়ান ফরমের কলামের তথ্য পূরণকে খানাপুরি বলা হয়।

নামজারি:

নামজারি মূলত কোন ব্যক্তি ক্রয়সূত্রে বা উত্তরাধিকার সূত্রে, বা যেকোন ধরণের সূত্রে হোক কোন জমির নতুন মালিক হন, তাহলে সে মালিকের নাম সরকারি খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়াকে নামজারি বলা হয় ।

পর্চা:

একটি চূড়ান্ত খতিয়ান প্রস্তুত করার আগে অবশ্যই উক্ত জমির মালিকের কাছে খসড়া খতিয়ানের কপি জমি মালিকদের দেয়া হয়ে থাকে তাকে মাঠ পর্চা বলা হয়। মাঠ পর্চাটি রেভিনিউ বা রাজস্ব অফিসারের দ্বারা সত্যায়িত করানোর পর যদি কারো আপত্তি থাকে তাহলে তা শুনানির পর আবার চূড়ান্ত ভাবে প্রকাশিত হয়। আর এই চূড়ান্ত খতিয়ানের কপি কে পর্চা বলা হয়।

তফসিল:

তফসিলে মৌজার নাম, খতিয়ানের নাম্বার, দাগ নম্বর, জমির চৌহদ্দি, জমির পরিমাণ সহ আরো নানা রকম তথ্য উল্লেখ থাকে।এক কথায় জমির সামগ্রিক পরিচয় বহন করে এমন বিবরণকে তফসিল বলা হয়।

চিটা:

জমির পরিমাণ, ধরণ ইত্যাদির পূর্ণ বিবরণকে চিটা বলা হয়।সম্পত্তি বাটোয়ারা বা ভাগের মামলায় প্রাথমিক ডিক্রীকে চূড়ান্ত ডিক্রীতে পরিণত করার পূর্বে অ্যাডভোকেট কমিশনার সম্পত্তি বাটোয়ারার সকল পক্ষদের জমি সরেজমিনে পরিমাপ করার পরেই পরামর্শ দেন।অ্যাডভোকেট কমিশনার জমিটির যে খসড়া ম্যাপ তৈরি করেন তাকে চিটা বা চিটা দাগ বলা হয়।

খাজনাঃ-

জমি ব্যবহারের জন্য সরকার বার্ষিক ভাবে দখলদারের কাছ থেকে যে কর আদায় করে তাকে জমির খাজনা বলা হয়।

দাখিলাঃ-

(ফর্ম নাম্বার- ১০৭৭) তে সরকার বা সম্পত্তির মালিককে জমির খাজনা দেয়া সময় একটি নির্দিষ্ট ফর্ম বা রসিদ প্রদান করতে হয় । এই ফর্মটিকে দাখিলা বা খাজনার রসিদ বলা হয়।

ডিসিআরঃ-

জমি/ ভূমির কর ব্যতীত অন্যান্য সরকারী পাওনা আদায় করার পর নির্ধারিত রসিদ/(ফর্ম নাম্বার ২২২) দেয়া হয় তাকে ডিসিআর বলা হয়।

পয়স্তিঃ-

নদী গর্ভ থেকে পলিমাটির স্তর জমে যে নতুন জমির সৃষ্টি হয় তাকে পয়ন্তি বলা হয়।

সিকস্তিঃ-

নদী ভাঙ্গনের ফলে বিশেষ জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় তাহলে তাকে সিকস্তি বলা হয় এবং সেই সিকস্তি জমি যদি পরবর্তী ৩০ বছরের মধ্যে পূনরায় আগের অবস্থানে ফিরে আসে তাহলে জমিটি সিকন্তি হওয়ার সময় যে মালিক ছিলেন তিনি অথবা তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে হতে জমিটির মালিকানা পাবেন।

ফারায়েজঃ-

ইসলামী বিধান অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বন্টন করার নিয়মকে ফারায়েজ বলা হয়।

ওয়ারিশঃ-

ওয়ারিশ শব্দটির অর্থ হচ্ছে উত্তরাধিকারী। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী কোন ব্যক্তি উইল না করে মারা গেলে তার স্ত্রী, সন্তান কিংবা নিকট আত্মীয়দের মধ্যে থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তি তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির মালিক হবেন।সে সকল ব্যক্তিবর্গকে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশ বলা হয়।

দখলনামাঃ-

দখলনামা হচ্ছে দখল বা মালিকানা পরিবর্তন ও হস্তান্তরের সনদপত্র বা সারটিফিকেট প্রদান করা। ক্রেতা একটি সম্পত্তি নিলামে ক্রয় করার পর সরকার পক্ষ ক্রেতাকে তার সম্পত্তিটির দখল বুঝিয়ে দেয়ার পর একটি সার্টিফিকেট প্রদান করে সেই সার্টিফিকেটটিকেই দখলনামা বলা হয়।

বায়নামাঃ-

১৯০৮ সালের দেওয়ানি আইনের কার্যবিধির ২১ নং আদেশের ৯৪ নম্বর নিয়ম অনুসারে কোন স্থায়ী সম্পত্তি নিলামে চূড়ান্ত বিক্রি ঘোষিত হলে আদালত ক্রেতাকে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে। এতে নিলামকৃত জমি সংক্রান্ত সব রকম বিস্তারিত তথ্য দেয়া থাকে।এই সার্টিফিকেট বা সনদকে বায়নামা বলা হয় । জমি কেনার আগে বিশেষ করে জমি বিক্রেতার মালিকানা এবং জমির বিভিন্ন দলিল ভালোভাবে যাচাই করতে হবে।

বিস্তারিত নিচে ক্রমান্বয়ে দেওয়া হলোঃ-

(১) জমি কেনার আগে অবশ্যই জমির মালিকানা যাচাই করতে হবে।
(২) ২০০৫ সাল থেকে জমি বিক্রয় দলিল সম্পাদন করার নতুন নিয়ম চালু হয়েছে যেটি উল্লেখ বরা হয়েছে জমির পূর্ববর্তী ন্যূনতম ২৫ বছরের মালিকানার ধারাবাহিক বিবরণ আছে কিনা তা উল্লেখ করতে হবে।
(৩) জমির মালিক অ্যাটর্নি নিয়োগ করেছে কি না জানতে হবে।
(৪) একজনের নামের জমি অন্য একজন ভুয়া দলিল দেখিয়ে বিক্রি করছে কি না জানতে হবে।
(৫) প্রস্তাবিত জমিটির সর্বশেষ রেকর্ডে বিক্রয়কারীর নাম উল্লেখ আছে কি না জানতে হবে।
(৬) সিএস, আরএসসহ অন্যান্য খতিয়ানের সাথে মিল আছে কিনা জানতে হবে।
(৭) ।প্রস্তাবিত জমিটি বিক্রয়কারীর দখলে আছে কিনা জানতে হবে।
(৮) সরোজমিনে নকশার সঙ্গে জমিটির বাস্তব মিল আছে কিনা দেখতে হবে।
(৯) জমির মালিক উত্তরাধিকারসূত্রে মালিক নাকি ক্রয়সূত্রে মালিক তা জানতে হবে ।
(১০) জমিটি সরকারি সংস্থা অধিগ্রহণ করেছে কি না জানতে হবে।
(১১) জমিটি নামজারি করা হয়েছে কি না দেখতে হবে।
(১২) জমিটি অর্পিত সম্পত্তি কি না তা জানতে হবে।
(১৩) ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা আছ কি না জানতে হবে।
(১৪) ভূমির কর না দেওয়ার কারণে কোনো সার্টিফিকেট মামলা আছে কি না জানতে হবে।
(১৫) জমিটির ওপর কোন মামলা আছে কি না জানতে হবে।
(১৬) জমির দলিল সঠিক আছে কি না দেখতে হবে।
(১৭) বিক্রেতার কাছ থেকে বিশেষ করে ভায়া দলিল নিতে হবে।
(১৮) সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে খোজ নিয়ে দেখতে হবে দলিলের ক্রমিক নম্বর, দলিল নম্বর ঠিক আছে কি না।
(১৯) ভালো করে দেখতে হবে দলিলের তারিখ, কাগজ, সিল ইত্যাদিতে কোন ভুল আছে কিনা ।
(২০) দান করা জমি হলে দলিল সম্পাদনের তারিখ দেখে কবে জমিতে গ্রহীতা দখলে গেছে তা যাচাই করতে হবে।
(২১) সম্পন্ন হওয়া বিক্রীত দলিলের দলিল লেখকের নাম ঠিকানা জেনে সরেজমিন কথা বলে নেওয়া দরকার।
(২২) পুরাতন দলিল ও নতুন দলিল যেমন (১) শিরোনাম (২) সাফ কবলা (৩) বায়না পত্র ইত্যাদি দেখতে হবে৷
(২৩) দলিল সম্পাদনকারী তথা জমি দাতা (বিক্রেতা) আইনের দৃষ্টিতে সাবালক ও সুস্থ মস্তিষ্কে সম্পন্ন কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে৷
(২৪) স্বত্ত্বের বর্ণনা: জমি দাতার মালিকানার ভিত্তি, দলিল মূলে হলে পূর্বের দলিলের নম্বর ও তারিখ পর্চা/খতিয়ান ইত্যাদি৷
(২৫) দলিলে প্রস্তাবিত জমির তফশিল যেমন জেলার নাম, উপজেলার নাম, রেজিস্ট্রি অফিসের নাম, মৌজার নাম, দাগ নং খতিয়ান নম্বর জমিটি কোন শ্রেণীর যেমন ভিটা, নাকি দলা, নাকি ডাঙ্গা নাকি জলাভূমিতে তা দেখতে হবে৷
(২৬) জমিটির চৌহদ্দি ঠিক আছে কিনা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম পাশের জমির বর্ণনা সহ মালিকের নাম উল্লেখ করতে হবে ৷

পরিশেষে বলা যায় যে জমি ক্রয়ের আগে আপনাকে দলিল, খতিয়ান, সি এস খতিয়ান, আর এস খতিয়ান , বি এস খতিয়ান, খানাপুরি, নামজারি, পর্চা, তফসিল, চিটা, খাজনা, দাখিলা, ডিসিআর, পয়স্তি, সিকস্তি, ফারায়েজ, ওয়ারিশ, দখলনামা, বায়নামাসহ আরো অনেক বিষয় সম্পর্কে জানা দরকার এতে করে একজন ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় উপকৃত হবেন এবং একজন ক্রেতা প্রতারণার হাত থেকে মুক্তি পাবেন।

Source: bdlawnews

Compare listings

Compare